চিলাহাটি-হলদিবাড়ী রেলপথ দীর্ঘ ৫৫ বছর পর নীলফামারীর চিলাহাটির সঙ্গে ভারতের হলদিবাড়ীর রেল যোগাযোগ চালুর পর বাধ ভাংগা উচ্ছাসে এই অঞ্চলের মানুষ। আজ বৃহস্পতিবার (১৭ ডিসেম্বর) ঘন কুয়াশা ভেদ করে অর্ধশত বছরের পর ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এই রেল যোগাযোগের উদ্বোধন করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এই ট্রানজিট রেলপথ উদ্বোধন প্রাণের উচ্ছাসে মেতেছে উত্তর জনপদের মানুষ। এই রেলপথ চালুর মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলে উন্নয়নের বিপ্লব আজ হতে শুরু এবং প্রসারিত হবে বিভিন্ন ব্যবসা বাণিজ্য।
আজকের উক্ত অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, রেলমন্ত্রী এ্যাড. নুরুল ইসলাম সুজন, বানিজ্য মন্ত্রী টিপু মুন্সী, জাতীয় সংসদ সদস্য নীলফামারী ১নং ও ৪নং আসনের এমপি বীর মুক্তিযোদ্ধা আফতাব উদ্দীন সরকার, আহসান আদেলুর রহমান আদেল, মহিলা সংসদ সদস্য রাবেয়া আলিম, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল আবেদীন, জেলা আওয়ামীলী্গের সভাপতি ও পৌর মেয়র দেওয়ান কামাল আহমেদ, জেলা প্রশাসক হাফিজুর রহমান চৌধুরী, পুলিশ সুপার মোখলেছুর রহমান, বাংলাদেশ রেলওয়ে, বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড(বিজিবি), কাস্টমস, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, এছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাবৃন্দ প্রমুখ।
রেলমন্ত্রী এ্যাড. নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, প্রকল্পের কাজ সমূহ জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ প্রকল্পের অনুমোদিত ব্যয় ৮০ কোটি ১৭ লাখ টাকা।
প্রকল্পের বিদ্যমান চুক্তির আওতায় মূল কাজ নতুন রেলপথ নির্মাণ (মেইনলাইন) ৬.৭২৪ কি.মি., নতুন রেলপথ নির্মাণ (লুপলাইন) ২.৩৬ কি.মি., মাইনর ব্রিজ নির্মাণ ৭টি, লেভেল ক্রসিং গেট ২টি, কালার লাইট সিগন্যালিংসহ, টেলিকমিউনিকেশন সিস্টেম প্রবর্তন- ১টি স্টেশন। বানিজ্য মন্ত্রী টিপু মুন্সী বললেন,
চিলাহাটি রেলপথটি চালু হলে বাংলাদেশের মোংলা পোর্ট এবং উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে ভারতের উত্তর-পূর্ব অংশ, নেপাল এবং ভূটানের মধ্যে আমদানি ও রপ্তানি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য যোগাযোগ অবকাঠামো মানোন্নয়নের মাধ্যমে বাণিজ্যিক কার্যক্রম জোরদার হবে। এর ফলে রেলওয়ের আয় বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশি পর্যটকরা দার্জিলিংসহ উত্তর-পূর্ব ভারতে দ্রুত ও সহজে ভ্রমণ করতে পারবেন।
স্থানীয় ব্যক্তি মনজুর আহমেদ ডন ও সাইফুল ইসলাম বলেন, এতদিন আমরা অনেক কষ্ট করে আসছি আজ তা দেখে মনে হচ্ছে দীর্ঘদিন পর আমরা সহজেই ভারতে গিয়ে চিকিৎসা সেবা, ব্যবসা বাণিজ্য ও ভ্রমণ করতে পারবো। এজন্য বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে লাখো লাখো অভিনন্দন জানান তারা।
উল্লেখ্য যে, ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর চিলাহাটি হতে হলদিবাড়ী পর্যন্ত রেল যোগাযোগ বন্ধ হওয়ায় দুই দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী রেলওয়ে সেবা হতে বঞ্চিত হয় এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে পড়ে। বর্তমান সরকার আন্তঃআঞ্চলিক যোগাযোগ জোরদার করণের মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্য ও পর্যটন খাতের উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
ভারত ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে চিলাহাটি ও হলদিবাড়ি হয়ে রেলওয়ে সংযোগ চালু ছিল। ১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের পর এ রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। যদিও বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে রেল যোগাযোগের ইতিহাস অনেক দিনের পুরনো। ১৮৬২ সালে চুয়াডাঙ্গার দর্শনা হতে জগতি পর্যন্ত ৫৩ দশমিক ১১ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেললাইন নির্মাণের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলে রেলওয়ের যাত্রা শুরু হয়।
১৮৭৪ হতে ১৮৭৯ সালের মধ্যে সাড়া (পাকশীর কাছে) হতে চিলাহাটি পর্যন্ত মিটার গেজ এবং দামুকদিয়া (সাড়ার উল্টো দিকে) হতে পোড়াদহ পর্যন্ত ব্রডগেজ রেললাইন নির্মাণ করা হয়। ১৯০৯ সালে পোড়াদহ হতে ভেড়ামাড়া পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইনকে দ্বৈত লাইনে রূপান্তর করা হয়। ১৯১৫ সালের ১লা জানুয়ারি হার্ডিঞ্জ ব্রিজ চালুর মধ্য দিয়ে দর্শনা হতে চিলাহাটি পর্যন্ত সরাসরি রেলওয়ে সংযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২৪ সালে সান্তাহার হতে পার্বতীপুর পর্যন্ত এবং ১৯২৬ সালে পার্বতীপুর হতে চিলাহাটি পর্যন্ত মিটারগেজ রেলওয়ে লাইন ব্রডগেজে রূপান্তর করা হয়।
এ সময় শিয়ালদহ ও শিলিগুড়ির মধ্যে সান্তাহার-পার্বতীপুর হয়ে দার্জিলিং এক্সপ্রেস ও নর্থবেঙ্গল এক্সপ্রেস নামে দ্রুতগতির ট্রেন চালু হয়। রেল যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই রুটটি তখন ব্যাকবোন হিসেবে বিবেচিত হতো। এতদিন রেলপথের এই লিংকটি চালু না থাকায় দুই দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী রেলওয়ে সেবা হতে বঞ্চিত হয়েছে এবং দুদেশের ব্যবসা বাণিজ্যে ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে মোট ৭টি ইন্টারচেঞ্জ পয়েন্টের মধ্যে ৪টিতে রেলওয়ে সংযোগ স্থাপিত হয়েছে। বর্তমানে ৫ম ইন্টারচেঞ্জ পয়েন্ট হিসেবে চিলাহাটি-হলদিবাড়ী রেলসংযোগটি সংযোজিত হচ্ছে।